নিউজ ডেস্ক: গত শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টা। সীমান্তবর্তী যশোরের বেনাপোল থেকে রওনা হওয়া বেতনা এক্সপ্রেস ট্রেনটি খুলনা রেলওয়ে স্টেশনে পৌঁছে। যাত্রীরা নেমে যে যার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে চলে যান। এরপর ট্রেনটির বগি থেকে প্রথমে নামেন রেল পুলিশের সদস্যরা। তাদের পরপরই নামতে থাকে শত শত কম্বল। প্রথমে বিষয়টি স্বাভাবিক মনে হলেও কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে আসে আসল রহস্য। ভারত থেকে চোরকারবারীরা হাজার হাজার কম্বল ট্রেনটিতে করে খুলনায় নিয়ে এসেছে। তাদের এ চোরচালানে যথেষ্ট সহানুভূতি রয়েছে রেল পুলিশ, রেলকর্মী ও রেলস্টেশনে কর্মরতদের। শুধু কম্বল নয়, চোরকারবারীরা আনছে ভারতীয় জিরা, প্রসাধনী, মাদকদ্রব্যসহ বিভিন্ন পণ্য। পুলিশের সহায়তায় নির্বিঘ্নে নামার পর তা ভ্যান, ইজিবাইক যোগে চল যাচ্ছে খুলনার বড় বাজারসহ বিভিন্ন বিপণি বিতানে। এরপর তা যাচ্ছে বিভিন্ন উপজেলায়।
নাম প্রকাশে ইচ্ছুক নন যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার এমন একজন চোরাকারবারীর সাথে এ সময় সাধারণ যাত্রী হিসেবে এই প্রতিবেদক কিছুটা সখ্য গড়ে তোলার পর তিনি জানান, ভারত সীমান্তের স্থলপথে কম্বল আসার পর প্রতি পিস কম্বলের জন্য সেখানে রেলস্টেশনে ১০০ টাকা, ট্রেনে উঠে রেল পুলিশকে ১০০ টাকা, রেলের টিটিকে ১০০ টাকা এবং খুলনা রেলস্টেশনে রেলকর্মীদের ১০০ করে মোট ৪০০ টাকা দিতে হয়। বেনাপোল থেকে খুলনা পর্যন্ত প্রতি পিস কম্বল আনতে এভাবে দিতে হয় ৪০০ টাকা। এসব টাকা আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট কিছু দালাল রয়েছে। শীত মৌসুমে গত দেড় মাস ধরে প্রতিদিন তার মত কয়েকজন ৭ থেকে ৮ হাজার পিস কম্বল আনেন। একটি কম্বল এক হাজার টাকায় কিনে বাকী ৪০০ টাকা চাঁদা দিয়ে কম্বলটি খুলনার পাইকারী মার্কেটে বিক্রি করা হয় ১৭০০ থেকে ১৮০০ টাকায়। একটি কম্বলে লাভ হয় ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা। আলাপচারিতার এক পর্যায়ে দু’জন রেল পুলিশের ইশারায় তিনি তার কাজে আবার লেগে পড়েন।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছেন, ভারত থেকে শুধু কম্বল নয়, ফেন্সিডিল, প্রসাধনী, বিভিন্ন ধরনের মশলা চোরচালান হয়ে থাকে। রেলের লোকজন, পুলিশসহ কয়েকটি মহলে চোরাকারবারীদের নিজস্ব নেটওয়ার্ক রয়েছে। কোনো ধরনের ভ্রাম্যমাণ আদালত বা অভিযানের খবর থাকলে খুলনা স্টেশনে পৌঁছানোর আগেই রেলগেট, দৌলতপুর, নতুন রাস্তা প্রভৃতি স্থানে আগেই চোরকারবারীদের নামিয়ে দেয়া হয়। চোরাকারবারীতে স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা জড়িত থাকায় দীর্ঘদিন ধরেই ঝটিকা অভিযান রেলস্টেশনে পরিচালনা করা হয় না।
খুলনা রেলওয়ে স্টেশনের মাস্টার মানিক সরকার জানান, খুলনা স্টেশনে চোরচালানীর মাধ্যমে ভারত থেকে পণ্য আনার কোনো তথ্য তার জানা নেই। তথ্য পেলে তিনি ব্যবস্থা নেবেন।
খুলনা রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন জিআরপি থানায় এ বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে গেলে উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া কোনো বক্তব্য দেয়া যাবে না এমনটাই জানালেন দায়িত্বরতরা।
খুলনা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হাসান আল মামুন এ বিষয়ে অবগত নন বলে জানান। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে বলে তিনি জানান।
খুলনার রেলওয়ে মার্কেটের পাইকারী কম্বল বিক্রেতা আমিনুল ইসলাম জানান, ভারত থেকে আসা কম্বলের মান ভাল, দামও ভাল। তাই বিক্রি করে লাভ হয়। এ জন্য খুলনার বাজারগুলোর অধিকাংশ বিক্রেতা ভারতীয় কম্বল বিক্রি করে থাকেন। বৈধ নাকি অবৈধ পথে এগুলো আসছে তা দেখার দায়িত্ব ব্যবসায়ীদের নয় বলে তিনি দাবি করেন।
অভিজ্ঞজনেরা বলছেন, ভারত থেকে দীর্ঘদিন ধরেই চোরাপথে পণ্য বাংলাদেশে আসছে। আগে আসতো শাড়ি কাপড়। এখন সবই আসছে। স্থানীয় বাজারের বড় একটি অংশ চোরাই পণ্যের দখলে। সীমান্তবর্তী যশোর, সাতক্ষীরার অবস্থা এখন এমন যে, পথেঘাটে সোনার বার পাওয়া যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, সীমান্তে এতো কড়াকড়ির পর কীভাবে এসব পণ্য দেশে ঢোকে? এরপর কীভাবে কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে পণ্যগুলো নির্দিষ্ট গন্তব্যে নির্বিঘ্নে পৌঁছে যায়? আবার একইভাবে সোনাসহ বিভিন্ন পণ্য বেআইনিভাবে কীভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ কাজে রাষ্ট্রের স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানের অসাধু সদস্যরাও জড়িত বলে অভিজ্ঞমহলের দাবি।