নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছেই। হাসপাতাল ও বিভিন্ন বেসরকারি ক্লিনিকে প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। বাসায় থেকেও চিকিৎসা নিচ্ছে অনেকে। অন্যান্য বছরের তুলনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার অনেক বেশি হওয়ায় ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। এ পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্যবিদরা। তারা বলছেন, শতভাগ প্রতিরোধযোগ্য এ রোগে এত মৃত্যুর হার দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাকেই প্রকাশ করে।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরিন স¤প্রতি জানিয়েছেন, ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি ধরনের (ডেন—১, ২, ৩ ও ৪) মধ্যে এবার একাধিক ডেন সক্রিয় রয়েছে। তারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে ২০০ নমুনা সংগ্রহ করে তাতে ডেন—১ ও ৪—এ আক্রান্তের হার বেশি পেয়েছেন। একাধিক ডেনে আক্রান্ত রোগীরাই বেশি মারা যাচ্ছে।
সরকারের দেয়া তথ্য সারা দেশের প্রকৃত ডেঙ্গুর চিত্র নয় বলে জানিয়েছে খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। মূলত রাজধানী ঢাকায় ২০টি সরকারি ও ৪৬টি বেসরকারি হাসপাতালে যেসব ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছে তাদের তথ্য কেবল দেয়া হচ্ছে। এর সঙ্গে যোগ করা হচ্ছে জেলা হাসপাতালের তথ্য। তবে এর বাইরে অসংখ্য রোগী সারা দেশের বিভিন্ন ক্লিনিক, ছোট—বড় হাসপাতাল ও বাড়িতে চিকিৎসা নিলেও সে তথ্য নেই সরকারের স্বাস্থ্যসেবা বাস্তবায়নকারী ও নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানটির কাছে।
এ বছর ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুর হার যে গতিতে বাড়ছে, তাতে বড় ধরনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন। তিনি বলেন, ‘গত ২৩ বছর ধরে ডেঙ্গুকে গুরুত্ব দেয়া হলেও তা মূলত মৌসুমকেন্দ্রিক কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ ছিল। কোনো রোগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে যে অবস্থানে থেকে কৌশল নির্ধারণ করা প্রয়োজন তা হয়নি। রোগীর অনুপাতে মৃত্যু বেশি হচ্ছে। কেননা রোগীরা শেষ মুহূর্তে চিকিৎসার আওতায় আসছেন। আর যে রোগী ও মৃত্যু সংখ্যা আমরা জানছি তা হাসপাতালভিত্তিক। এর বাইরে যেসব রোগী রয়েছে এবং মৃত্যু হচ্ছে তা হিসাবের বাইরে থাকছে। রয়েছে কৌশলগত পর্যবেক্ষণের ঘাটতি।’
এর আগে গত রোববার রাজধানীতে ডেঙ্গুবিষয়ক এক বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে এ রোগতত্ত্ববিদ বলেছিলেন, ‘চলতি বছর মশাবাহিত সংক্রামক রোগ ডেঙ্গু উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এ মুহূর্তে দেশে জনস্বাস্থ্যের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা উচিত।’
তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের জন্য সিটি করপোরেশনগুলো বিভিন্ন এলাকায় জরিমানা করছে। তবে জরিমানা করে জনস্বাস্থ্যের সমস্যার সমাধান করা যায় না। বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।’ যদিও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব ড. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম ওইদিন এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিলেন, জনস্বাস্থ্যের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি।
দেশে রোগ ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. বে—নজির আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমাদের আইইডিসিআরকে যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসির মতো হওয়া উচিত ছিল। রোগতত্ত্ব নিয়ে গবেষণায় ঘাটতি রয়েছে। প্রতিটি জেলায় রোগতত্ত্ব নিয়ে গবেষণার জন্য আইইডিসিআরের কেন্দ্র থাকা উচিত। ভাইরাস প্রতিনিয়তই চরিত্র বদলায়। আজকে যে ডেঙ্গু আমরা দেখছি তা আগে দেখা যায়নি। ফলে গবেষণাকে গুরুত্ব দিতে হবে। শুধু মৌসুমি রোগ বিবেচনায় নিয়ে কোনো কাজ হচ্ছে না। একই সঙ্গে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাকে বড় আকারে নিতে হবে। যেকোনো মূল্যে রোগীর যেন মৃত্যু না হয়। যেসব রোগী মারা যাচ্ছে তারা কেন মারা যাচ্ছে, চিকিৎসার কোন পর্যায়ে মারা গেছে তা নিয়ে গবেষণা করতে হবে। রোগীদের বেশির ভাগই মারা যাচ্ছে সঠিক সময়ে চিকিৎসার আওতায় না আসার কারণে।